মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী নামে অধিক
পরিচিত (সেপ্টেম্বর
১, ১৯১৮ - ফেব্রুয়ারি ১৬,১৯৮৪), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও
সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন।
ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে। তাঁর পিতৃপুরুষের বাড়ি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার (বর্তমানে ওসমানীনগর থানা) দয়ামীরে। তাঁর পিতা খান বাহাদুর
মফিজুর রহমান, মাতা জোবেদা খাতুন।
পিতার চাকরির সূত্রে তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জায়গায়। তাই কিছুদিন পর বদলির আদেশ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয়
গোহাটিতে৷ আর সেখানেই ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয়৷১৯২৩ সালে 'কটনস্ স্কুল
অব আসাম'-এ ভর্তি হন তিনি ৷ লেখাপড়ায় যে তিনি খুবই মনোযোগী ছিলেন তার
প্রমাণ হলো স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন৷ ১৯৩২ সালে ওসমানী সিলেট গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুল এ ভর্তি হন ৷
তৎকালীন সময়ে সিলেটের এই স্কুলটি 'ক্যালকাটা
ইউনিভর্সিটির' অধীনে ছিল৷ ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি
উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে৷ সমগ্র ব্রিটিশ
ভারতে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন৷ এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার এম. এ.
জি. ওসমানীকে প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করে। আলীগড় মুসলিম
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক
ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৩৮ সালে।
১৯৩৯ সালে তিনি রয়্যাল
আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। দেরাদুনে ব্রিটিশ - ভারতীয়
মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কমিশনড অফিসার হিসেবে। ১৯৪২ সালে মেজর পদে
উন্নীত হন। ১৯৪২ সালে ওসমানী
ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ওসমানী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে লং কোর্স পরীক্ষা দিয়ে উচ্চস্থান
লাভ করেন৷ সে বছর তিনি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও মনোনীত হন৷ কিন্তু
তিনি সামরিক বাহিনীতেই থেকে যান। দেশবিভাগের পর ১৯৪৭সালের ৭ই অক্টোবর ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ
দেন। এসময় তাঁর পদমর্যাদা ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেলের। ১৯৪৯ সালে তিনি চীফ অফ
জেনারেল স্টাফের ডেপুটি হন। ১৯৫১ সনে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ১ম ব্যাটেলিয়নের
অধিনায়ক নিযুক্ত হন৷ এর পর তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন৷ পরবর্তীকালে
তিনি ১৪তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর ৯ম
ব্যাটেলিয়ানের রাইফেলস কোম্পানির পরিচালক, ইস্ট পাকিস্তান
রাইফেলস (ই.পি.আর.)-এর অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট, সেনাবাহিনীর জেনারেল
স্টাফ অফিসার প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কর্নেল
পদমর্যাদা লাভ করেন এবং সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের জেনারেল স্টাফ এন্ড মিলিটারি
অপারেশনের ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পান। ১৯৬৫ সালের
পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন৷ 'ডেপুটি
ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন' হিসেবে যুদ্ধরত
বিভিন্ন সামরিক হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করতেন তিনি ৷ পাক-ভারত যুদ্ধ যখন শেষ হয়
তখন তাঁর বয়স চল্লিশের উপরে৷ ১৯৬৬ সালের মে মাসে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে
অবসরকালীন ছুটি নেন এবং পরের বছর (১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে '৭০-এর
নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের
সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ
করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী
তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ
দেন৷ ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরঅবকাঠামো গঠনের
কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে
ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য যে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী ও সরকার
গঠন করা হয় এবং পরবর্তীকালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭
এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর
প্রধান সেনাপতি।
ওসমানী'র নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার
হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে
সমন্বয়সাধন করা, রাজনৈতিক
নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের
যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা করা - প্রভৃতি কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন ওসমানী। ১২ এপ্রিল থেকে এম. এ. জি. ওসমানী
মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার
দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে
ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন এবং বিচক্ষণতার সাথে
সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায়
অনেক বেশি৷ এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে
রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা৷ এজন্য এম. এ. জি.
ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন৷ মে মাসের পর তাঁর
মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা
গেলেও ধ্বংস করা সম্ভব নয়৷ এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত
পরিবর্তন আনেন৷ প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি
গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন।
১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে
নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে দায়িত্ব থেকে অবসর নেন, মন্ত্রীসভায় যোগ
দেন অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের
মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ঐ নির্বাচনে ওসমানী
তাঁর নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন৷ ১৯৭৩ এর
নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন৷ ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ
যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি এম. এ. জি. ওসমানী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ
সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত করা হয়।
Comments
Post a Comment