হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী (জন্ম: সেপ্টেম্বর ৮, ১৮৯২ - মৃত্যু: ডিসেম্বর ৫ ১৯৬৩) বিখ্যাত বাঙ্গালী
রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ছিলেন। যুক্তফ্রন্টগঠনের মূলনেতাদের মধ্যে অন্যতম। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাই সুধী সমাজ
কর্তৃক 'গণতন্ত্রের মানসপুত্র' বলে আখ্যায়িত হন।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার
জন্ম। তিনি ছিলেন বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দির কনিষ্ঠ সন্তান। তার পরিবারের সদস্যবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত মুসলিম
পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দি নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেন এবং বাংলার
চর্চা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স
কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান
বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি তার
মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবি ভাষা এবং
সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে
পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যেরঅক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে
সম্মানসহ স্নাতক অর্জন করেন। এছাড়া এখানে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রী
অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে গ্রে'স ইন হতে বার এট ল ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে
এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
১৯২৪-১৯৪৭
:
প্রথমে তিনি যোগ দেন চিত্তরঞ্জন দাসের
স্বরাজ পার্টিতে। এটি তখন
মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের
অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ ছিল। ১৯২৩ এর
বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯২৪ সালে
তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র ছিলেন চিত্তরঞ্জন
দাস। ১৯২৭ সালে
সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। ১৯২৮ সালে
সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের
মধ্যে তার ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তিনি
জড়িত হননি। ১৯৩৬ সালের
শুরুর দিকে তিনি ইন্ডিপেন্ড্যান্ট মুসলিম পার্টি নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৬ এর শেষের দিকে এই দলটি বাংলা
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাথে একীভূত হয়। এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ তথা বিপিএমএল এর
সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের
শেষ দিক পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। ১৯৪৬ এর নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক
মুসলিম লীগের বিপুল বিজয়ে তিনি এবং আবুল হাশিম মূল
কৃতিত্বের দাবীদার ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে
পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ব্যাপক সমর্থন প্রদান করেন।পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬
সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট
মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের আগস্ট ১৬ তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
দিবসের ডাক দেন। বাংলায়
সোহরাওয়ার্দির প্ররোচনায় এই দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। তার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে দিল্লী
সম্মেলনে মুসলিম লীগের আইন প্রণেতাদের নিকট লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী পেশ করা হয়। এই সংশোধনীতে অখন্ড স্বাধীন বাংলার
প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কলকাতায়
হিন্দু মুসলমান রায়টে তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হিন্দুদের নিকট তার
গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে শরৎচন্দ্র
বসু ছাড়া কংগ্রেসের আর কোন নেতা তার অখণ্ড বাংলার ধারণার সাথে
একমত ছিলেন না। ১৯৪৭ সালে
তিনি বাংলার মূখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান।১৯৪৯ সালে তৎকালীন ভারত সরকার তার উপর
ক্রমবর্ধমান করের বোঝা চাপালে তিনি ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য হন।
১৯৪৭-১৯৬২ :
১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে মুসলিম লীগের
রক্ষনশীল নেতারা খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে উঠেন। এর আগে ১৯৪৭ সালের আগস্ট ৫ এ খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর
পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল
নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা
নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে "ভারতীয়
এজেন্ট" এবং "পাকিস্তানের শত্রু" হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত
করা হয়।
তার অনুসারী রা অনেকে ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং ১৯৪৯ এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম
লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন
ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'
প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে ধর্মনিরপেক্ষতার
চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে 'মুসলিম'
শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের
সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত
হোসেন ও আলী আহমদ।
টাঙ্গাইলের শামসুল হক
সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল
হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয়
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর
সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে
একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন
উপলক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই
যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী
মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান
গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন - ১) মওলানা ভাসানী, ২) একে
ফজলুল হক ও ৩) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই
যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল - ১) লাহোর প্রসত্দাবের
ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও
সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা
ইত্যাদি।
১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব
পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী
মুসলিম লীগ।
১৯৫৪
সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম
ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে
পরাভূত হয়। তারা
শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ 'মুসলিম' শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার
মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ডিসেম্বর ২০, ১৯৫৪ হতে আগস্ট, ১৯৫৫ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। আগস্ট ১১, ১৯৫৫ হতে সেপ্টেম্বর ১,
১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে
পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সেপ্টেম্বর ১২, ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১১, ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬
সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত
হন। পররাষ্ট্র বিষয়ে
পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে তাকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা
হয়। ১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের
ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া
হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী
লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাকলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯৫৮সালে ইস্কান্দার
মীর্জা পাকিস্তানে
সামরিক শাসন জারী করেন। আগস্ট,১৯৫৯ হতে ইলেক্টিভ বডি
ডিসকুয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা
হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা
আইনে রাস্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২ তে
তাকে গ্রেফতার করা
হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। আগস্ট ১৯, ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান।
স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৩ সালে দেশের বাইরে যান এবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে ডিসেম্বর, ১৯৬৩ তে তিনি মারা
যান। তাঁর মৃত্যু
অনেকের কাছে রহস্যমণ্ডিত।
Comments
Post a Comment